গল্প-১


এক মধ্যরাতে গ্র্যান্ডপা (দাদু) আমায় ডেকে পাঠালেন। তখন তার অবস্থা সঙ্গিন। মাঝেমধ্যেই জ্ঞান হারান। বার বার বলছিলেন, আমার সময় বেশি নাই, আমার সময় বেশি নাই।

আমি তার সামনে গেলে তার অস্থিরতা যেন উবে গেলো। তিনি ঘরের সকলকে বেরিয়ে যেতে বললেন। গম্ভীর হয়ে আমাকে বললেন, দাদুভাই বোসো।

আমি দাদুর বিছানায় বসলাম। তিনি শুয়ে ছিলেন। আমার হাত ধরে বললেন, দাদুভাই, আমি মৃত্যুর খুব কাছাকাছি। তোমাকে একটা দায়িত্ব দিয়ে যেতে চাই।

আমি হয়ে বললাম, কি দায়িত্ব বলুন।

দাদু বললেন, শান্ত হও বাছা। এই দায়িত্ব এমন কিছু যা কাঁধে নিলে কাধ ভেঙ্গে পড়তে পারে, এই দায়িত্ব পালনের জন্য লাগবে মজবুত কাঁধ।

আমি আগা মাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। তিনি তখন বললেন, ভালো আর খারাপের দ্বন্দ চিরন্তন। যেদিকে মুসা থাকবে এর উল্টো দিকে থাকবে ফেরাউন, যেদিকে মুহাম্মদ থাকবে এর বিপরীত দিকে থাকবে আবু জেহেলরা।

আমি মাথা নাড়লাম।

তিনি বললেন, এইযে ভালো আর খারাপের দ্বন্দ, ইসলাম এবং জাহেলিয়াতের দ্বন্দ, এর মধ্য থেকে যে কোনো এক পক্ষ বেছে নিতে হবে, মাঝখানের কোনো অবস্থান নাই।

তিনি এইটুকু বলে খুব হাঁপাচ্ছিলেন। আমি বললাম, বাকিটা পরে শুনবো, আপনি বিশ্রাম নিন...

তিনি বললেন, না। শুনে যাও দাদু। আমার এই কথাকে গুরুত্বের সাথে নেও। মৃত্যুপথ যাত্রির আমানত হিসেবে গ্রহণ করো।

আমি বললাম, মূল বিষয়টা বলুন। আপনার তো কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।

তিনি বললেন, তোমার সৌভাগ্য তোমায় কেউ এসব বলে যাচ্ছে। আমাকে কেউ কোনোদিন এরুপ কিছু জানায় নি, বলে নি। তাই এই দীর্ঘ জীবন এক অন্ধকারে বাস করেছি।

আমি আবারো কিছু বুঝতে পারলাম না, দাদুর মাথা ঠিক আছে তো?

তিনি আবার শুরু করলেন, আমি যে বয়সে এসে হিদায়াত পেয়েছি সেটা খুব দেরি হয়ে গেছে। এমন বয়সে উপনীত হয়েছি ইসলামের খিদমাতে কিছুই করতে পারলাম না। আমার অর্জন শুন্য দাদু ভাই, আমার অর্জন শুন্য...

এতো টুকু বলে তিনি খুব ইমোশনাল হয়ে গেলেন, তার কণ্ঠ ভারি হয়ে এসেছিল।

এরপর বললেন, সারাজীবন আমি কি করলাম? কি পেলাম? পড়াশোনা, ক্যারিয়ার আর চাকরীর পিছনে ছুটতে ছুটতে চুল দাড়ি সাদা করে ফেললাম। আমার কি অর্জন, এখন আমার মৃত্যু হচ্ছে আমি অনন্ত জীবনের দিকে যাত্রা করছি, সেই অনন্ত কালের জন্য আমার কি অর্জন?

তার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

তিনি আমার হাত চেপে ধরে বললেন, দাদু ভাই, তোমাকে আমি এক মহান দায়িত্ব দিয়ে যেতে চাই। আমি কিছুই করতে পারি নি, বরং সারাজীবন জাহেলিয়াতকে সাপোর্ট করে গেছি। আমি চাই, তুমি নিজেকে দ্বীন আল ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত করো।

আমি বললাম, কিন্তু দাদু, আমি পড়াশোনা করি, আমার অনেক ব্যাস্ততা। আর আমি ধর্ম সম্পর্কে অতো ইন্টারেস্টেড নই। হ্যাঁ, আমি আস্তিক বটে, কিন্তু আমি এ ব্যাপারে আগ্রহি নই। তাছাড়া আমি ইসলাম বিষয়ে তেমন কিছু জানিও না।

তিনি যেন আশাহত হলেন, কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, বললেন, দেখো, আমি যে ভুল করেছি এর মাশুল কোনো দিন করা সম্ভব নয়। আমি তোমাদের বাবা-চাচাদের বস্তুবাদী শিক্ষায় শিক্ষিত করেছি এখন তারা দেশের সবচেয়ে বড় এথিস্ট, এথেইজমের প্রচারক। অথচ আমি বৃদ্ধ বয়সে এসে আমার ভুল বুঝতে পারলাম, কিন্তু তাদের কি আর ওই অন্ধকারের পথ থেকে ফেরাতে পারবো!

একটু থেমে আবার বললেন, এই কথাটা শুধু তোমাকেই কেনো বললাম, কারণ আমার মনে হয়েছে তুমি বুদ্ধিমান, আমার কথাটা বুঝতে পারবে। তুমি তোমার বাবা-চাচার মত এথিস্ট নও, তুমি ভাবতে পারো এবং নিজেকে বদলাতেও পারো। তুমি এই বিষয়টা একটু ভেবে দেখো। শুধু একটু ভেবে দেখার অনুরোধ। আর কিছু নয়, আমার অন্তিম ইচ্ছা তুমি পূরণ করবে আশা করি।

এরপর তিনি চোখ বুজলেন। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। এরপর বললাম, দাদুভাই উঠবো?

তিনি চোখ বুজে রইলেন, কিছু বললেন না।

আমি উঠে যেতে নিলাম। কি যেন মনে করে হঠাৎ পিছে ফিরে দাদুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দাদুকে আজ অনেক উজ্জ্বল লাগছে, তার শুভ্র দাড়িতে যেন তাকে কোনো সুলতান, কোনো বাদশাহর মতন লাগছে। তার ঠোটের কোণে ফুটে উঠেছে এক টুকরো হাসি।

দাদুকে আস্তে করে ডাকলাম, দাদুভাই।

কোনো সাড়া পেলাম না। তার হাসি যেন চওড়া হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তিনি এই দুনিয়ার কেউ নন। অদ্ভুত সুন্দর এক সুবাসে ঘর ভরে উঠেছিল।

আমি দ্রুত দাদুর পালস দেখলাম। তিনি তখন আর জীবিত নেই।

আমি আরো কয়েকবার ডাকলাম তাকে। তিনি সাড়া দিচ্ছিলেন না, কিন্তু তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি হাসছেন, অল্প করে হাসছেন। এই হাসি দুনিয়ার হাসি নয়। এই হাসির ব্যাখ্যা করতেও দুনিয়ার কোনো ভাষা সক্ষম নয়।

গ্র্যান্ডপা'র মৃত্যু আমার মনোজগতে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আমি তার কথাগুলো নিয়ে অনেক ভাবতে লাগলাম। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না।

একটু ভাবার জন্য অনেক দূরে দূরে চলে যেতাম। জন-মানবহীন জায়গাগুলোতে। একা একা বসে থাকতাম আর ভাবতাম। একদিন এক পড়ন্ত বিকেলে কোনো পার্কের বেঞ্চিতে বসে ছিলাম। পাশে ছিল কয়েকটা কাগজ। বুক পকেট থেকে কি মনে করে কলমটা বের করে খচখচ করে কাগজে কয়েকটা লাইন লিখে ফেললাম।

সত্য আর মিথ্যার দ্বন্দ চিরন্তন। এক পক্ষে মুসা থাকবে অন্য পক্ষে ফেরাউন, এক পক্ষে মুহাম্মদ থাকবে, অন্য পক্ষে আবু জেহেল। তোমাকে ভেবে নিতে হবে মহামানব মুহাম্মদ বা মুসার পথে যাবে নাকি নিকৃষ্ট ফেরাউন আবু জেহেলের পথে? এর মাঝা মাঝি কোনো পথ নেই। সত্যের এই পথ গিয়ে ঠেকেছে জান্নাতে আর মিথ্যার পথ জাহান্নামে।

লেখার পর আমার মনে তখন উত্তাল আনন্দের ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। যেন আমি আমার পথ খুঁজে পেয়েছি। আমি এমন কিছু পেয়েছি যার বর্ণনা ব্যাখ্যাতীত। আমার মনে হচ্ছিল এর চেয়ে আনন্দের দিন আর হতে পারে না। আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল। আমি বুঝতে পারলাম, সেদিন দাদুর চোখ দিয়ে কেনো অশ্রু গড়িয়েছিল। এ অশ্রু আনন্দের। আমার মনে হচ্ছিল আমি যা পেয়েছি এর চেয়ে বড় আর কিছুই হতে পারে না।

আমি একটা আলো খুঁজে পেয়েছি, সেদিন আমি কুরআন প্রথম হাতে নিলাম।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে নারী সাহাবী যোদ্ধা ছিলেন

বই রিভিউঃ নসীম হিজাযীর শেষ প্রান্তর

যুদ্ধ ও ক্ষমতার সমীকরণঃ কে বেশি শক্তিশালী