উসমানীয় পলিমেথ
উসমানীয় সাম্রাজ্যে প্রথম ছাপখানার জনক ইব্রাহিম মুতেফেররিকা (১৬৭৪-১৭৪৫) যিনি ছিলেন একজন পলিমেথ। পলিমেথ মানে হচ্ছে বহুবিদ্যাবিশারদ। মধ্যযুগের ইসলামী স্বর্ণালী যুগে বেশির ভাগ বিজ্ঞানীই ছিলেন পলিমেথ। প্রায় সব বিজ্ঞানী, ইবনে সিনা, ওমর খৈয়াম, আল-বাত্তানি, আল-বিরুনি, আল-রাযী, ইবনে হাইসাম এরকম অনেকের নাম বলা যায়।
পলিমেথের সংস্কৃতি মূলত মুসলিম বিজ্ঞানীদের দ্বারাই সূচীত হয়, এরপর তা ইউরোপে যায়। তবে আধুনিক যুগে পলিমেথ হচ্ছে হ্যালির ধূমকেতুর মতই বিরল, ৭৬ বছরের মধ্যে দেখা গেলেও যেতে পারে কদাচিৎ। তাও সম্ভাবনা কম। কিন্তু ইসলামী স্বর্ণযুগের জ্ঞানী বিজ্ঞানী যত জনকে জানি প্রায় সকলেই ছিলেন পলিমেথ। এখনের যুগে পলিমেথ হওয়া অসম্ভবের কাছাকাছি কারণ জ্ঞান বিজ্ঞানের শাখা প্রশাখা এতো বেড়ে গিয়েছে আর প্রতিটি শাখা এতো বিস্তৃতি লাভ করেছে যে এক সাবজেক্ট নিয়েই সারাজীবন কেটে যায়। আমার বড্ড ইচ্ছে ছিল পলিমেথ হবো। কিন্তু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ব্যারিস্টার (আবার ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ভেতর হাজারটা শাখা প্রশাখা) একত্রে হওয়া সম্ভব কি? এই যুগে! নন-অ্যাকাডেমিকগুলোর কথা বাদ-ই দিলাম। হুম সম্ভব, যদি কেউ হাজার বছর বাঁচে।

প্রসঙ্গে ফিরি, ইব্রাহিম মুতেফেররিকা হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভূত খ্রিস্টান ছিলেন, পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের একজন বিখ্যাত কূটনীতিবিদ ছিলেন, তাছাড়া ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, প্রকাশক, অর্থনীতিবিদ, রাজসভাসদ ও রাজনীতিবিদ, লেখক, দার্শনিক, ইতিহাসবেত্তা, ধর্মতত্ত্ববিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং ইসলামিক স্কলার।
তিনি সুলতান তৃতীয় আহমেদের সময়কালীন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন।
সুলতান সুলেইমানের সময়কালীন মাত্রাকচি নাসুহ ছিলেন মানব ইতিহাসের প্রথম সারির কয়েক জন পলিমেথের একজন। ইতিহাস-বিকৃত করা ওই জনপ্রিয় সিরিয়ালে (নাটকে) তাকে এমন ভাবে উপস্থাপন করে, দেখে মনে হয়েছে তিনি কিছুই ছিলেন না; আসলে নাসুহ এফেন্দি ছিলেন একজন বড় মাপের বিজ্ঞানী, কূটনৈতিক, পলিমেথ, গণিতবিদ, সৈনিক, শিক্ষক, অস্ত্র-নির্মাতা, ইতিহাসবিদ, ভূগোলবিদ, তলোয়ার যোদ্ধা বা খেলুড়ে, লেখক ও কবি, চিত্রশিল্পী, মানচিত্রবিদ, নাবিক, ক্যালিগ্রাফার, আবিষ্কারক, সমরবিদ, অনুচিত্রশিল্পী, দার্শনিক এবং আরো অনেক কিছু।
উসমানীয় সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী যাকে ধরা হয় তাকিউদ্দিন ইবনে মা'রুফ, তিনিও একজন পলিমেথ ছিলেন, আলোকবিজ্ঞান নিয়ে তার অনেক বিখ্যাত আবিষ্কার রয়েছে, বিজ্ঞানে প্রতিটি শাখায় তার অবদান রয়েছে, তিনি কি ছিলেন এটা বললে লিস্ট অনেক বড় হবে, তিনি বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের জন্য কিংবদন্তী হয়ে আছেন।
বিজ্ঞানী আলি কুশজিও এরুপ একজন ছিলেন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, মেকানিক্স বা বলবিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব, কালামশাস্ত্র, ফিকাহ এবং পদার্থবিজ্ঞানে তার বিস্তর অবদান রয়েছে।
ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটির প্রথম রেক্টর হাসান তাহসিনি একই সাথে একজন ইসলামিক স্কলার ছিলেন আবার পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, দার্শনিক এবং মনোবিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি আলবেনিয়ান মানবাধিকার কর্মী ছিলেন এবং শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। তবে তার উদারনীতি কখনো কখনো সীমা অতিক্রম করেছিল।
এরকম আরো অনেক পলিমেথ ছিল উসমানীয় যুগে; চিকিৎসাবিদ ও সার্জন সেফারেদ্দিন সাবুনছোগ্লু (১৩৮৫-১৪৬৮) যাকে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যতম জনক বলা যেতে পারে। আরো কয়েকজন বিখ্যাত উসমানীয় পলিমেথ বিজ্ঞানীর মধ্যে গেলেনবেভি ইসমাঈল এফেন্দি, আব্বাস ওয়াসিম এফেন্দি, মিরিম চেলেবি, ইব্রাহিম হাক্কি এরজুরুমি, কাযিজাদা আল রুমি, ইউসুফ সিনান পাশা, খলিল আল-হুসাইনি অন্যতম।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন